এই কলকাতার কত কিছুই জানা থাকে না। কত কিছুই চোখে পড়ে না। জানাই হয় না ভদ্রলোকের কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখে ‘ঝি লোকাল’।
মাসি-পিসিদের ট্রেন ভোরের আপ ক্যানিং শিয়ালদহ লোকাল। না, সবাই নয় তবু ওই ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রীরই পরিচয় ‘ওরা কাজ করে’। ওঁরা ‘কাজের লোক’।
৩৪৫১৩ আপ ক্যানিং-শিয়ালদা লোকাল। এটাকেই বলে ‘ঝি লোকাল’। না যাত্রীরা বলেন না, বলেন যাত্রীদের মনিবরা। ওই ট্রেন থেকে নেমেই তো দলে দলে মধ্য থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণতর কলকাতার ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে পড়েন কাজের মাসিরা। ছড়িয়ে পড়েন বাংলা নামের আবাসন থেকে গ্রিনসিটি, পিঙ্কসিটি অ্যাপার্টমেন্টে। এক এক জনের চার-পাঁচ বাড়ি। কোথাও রান্না, কোথাও ঠিকে কাজ।
ওই ট্রেনটাকে এলেবেলে ভাবা যাবে না। ওটি লেট করা মানেই বাসি কাপড়, এঁটো বাসন আরও বাসি হবে। অফিসটাইমের ভাত লেট হয়ে যায়। টিফিনে হরিমটর। টাইমটেবল অনুযায়ী ভোর ৪টে ৩২ মিনিটে ক্যানিং ছেড়ে ৫টা ৪৭ মিনিটে শিয়ালদহে ঢোকে। কলকাতা তখন সবে আড়মোড়া ভাঙছে। তার আগে থাকতেই ‘ঝি লোকাল’ খালি হতে থাকে বাঘাযতীন, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া স্টেশনে। এলিট ও পশ কলকাতাকে উদ্ধার করতে চলে আসে ক্যানিং।
শুধু যে এই ট্রেনটা তা-ই নয়। এর আগেও আছে। পরেও আছে। অন্যের বাড়ি ‘ঝি-গিরি’ করতে যাঁরা আসেন তাঁরা ঘুম থেকে ওঠেন অনেক অনেক আগে। কাজের বাড়ি মাইনে দিলে তবে মান্থলি। অনেকে পয়সা কেটে নেয় কামাইয়ের হিসেব কষে। টাকা পাওয়াও প্রায় মাসেই দু’চারটে দিন পিছিয়ে যায়। তখন আরও ভোরে উঠতে হয়। ৩৪৫১১ আপ ধরতে হয় ৩টে ৫০ মিনিটে। ওটায় চেকার থাকে না।
দেখবেন নাকি একদিন পরখ করে? চোখে না দেখলে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবেন না। এই কলকাতায় আসছে একটা ট্রেন যার বগির পর বগি বোঝাই করা ‘কাজের লোক’। কারও স্বামী পঙ্গু, কারও স্বামী কাজ হারিয়ে বেকার। কারও বর আবার সন্তানের জন্ম দেওয়া আর মদ খাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। কারও কপাল পুড়েছে বিয়ের পরে পরেই। কিন্তু পেটের ছা গুলোকে খাওয়াতে হবে। একটু আধটু ‘নেকাপড়া’শেখানোর স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাই অন্ধকার থাকতে উঠে সংসার সামলে পায়ে পায়ে আসতে হয় ক্যানিং, তালদি, পিয়ালি, চম্পাহাটি স্টেশনে।
চড়বেন নাকি ওই ট্রেনে একদিন? গা ঘিনঘিন করতে পারে ওদের পোশাক দেখলে, কথা শুনলে। কেউ ঢুলছে। কেউ বকবক করছে। গাল পারছে ‘ভদ্দর-লোক’ মনিব কিংবা মনিব-গিন্নিকে। ওই গালাগাল গায়ে মাখলে চলবে না। সইয়ে নিতে হবে। ‘ভোট-ফোট’ নিয়ে আলোচনা পাবেন না। ওঁদের কথায় ‘সবা শালা হারামির বাচ্চা’। ‘টিপিন’ না দেওয়া মনিব আর ‘পাটি’ওঁদের কাছে এক। দিদি কিংবা দাদা এক ‘গোত্তর’।
সম্মান-অসম্মান নিয়ে ভাববেন না। ওঁরা অন্তত ভাবে না। ‘ঝি-লোকাল’ শব্দটা আপনার কাছে অমর্যাদার মনে হতে পারে কিন্তু ওই ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের কাছে ওটাই গর্বের। কারণ, ওঁরা জানেন, এক বেলা ডুব মারলে গিন্নিরা সব ‘মুচ্ছো’যাবেন। নিজের সংসারে যতই হেলাফেলার হন ‘গতর’-এর জোরে বাবু-বিবির সংসারে ওঁরাই তো ‘নয়নের-মণি’।
‘ঝি-লোকাল’ বললে ওঁদের কিস্যু যায় আসে না।
0 comments:
Post a Comment